সিরাজুর রহমান#
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের সোলার সিস্টেমের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা জটিল প্রাণের উপযোগী পরিবেশে অজানা এলিয়েন লাইফের অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে। এর মধ্যে এনসেলাডাস, ইউরোপা এবং টাইটান উপগ্রহের পাশাপাশি গ্রহাণু বলয়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় বামন গ্রহ ‘সেরেস’-কে অন্যতম সম্ভাব্য স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মূলত গত ২০১৫ সালে নাসার ডন (Dawn) স্পেস মিশন থেকে পাঠানো ছবির বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, সেরেসের বরফ ও শিলাময় আবরণের নিচে বিপুল পরিমাণ তরল পানি থাকতে পারে। যদিও এটি এখনো পর্যন্ত একটি বৈজ্ঞানিক অনুমান বলে মনে করা হয়। আর এই অজানা রহস্য উন্মোচনের জন্য ভবিষ্যতে নতুন স্পেস মিশন পরিচালনার পরিকল্পনা করছে নাসা।
আমাদের সোলার সিস্টেমের বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহের মাঝখানে গ্রহাণু বলয়ের ভেতরে অবস্থান করা বামন গ্রহ ‘সেরেস’ আজ বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। মাত্র ৯৫০ কিলোমিটার ব্যাসবিশিষ্ট এই গ্রহটি গ্রহাণুপুঞ্জের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভর ধারণ করে আছে, যা একে বলয়ের সবচেয়ে বড় অবজেক্টে পরিণত করেছে। এর ভর পৃথিবীর প্রায় ০.০০০১৬ ভরের সমান।
আসলে গত ২০১৫ সালে NASA’র Dawn স্পেস-ক্র্যাফট সেরেসের পৃষ্ঠের কিছু উজ্জ্বল সাদা দাগের ছবি পাঠায়, যা পরে বিজ্ঞানীরা “Occator Crater”-এ লবণাক্ত স্তর হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই স্তরগুলো মূলত সোডিয়াম কার্বনেট, যা পৃথিবীতেও পাওয়া যায়, এবং এগুলো কোনো গ্রহাণুর আঘাতে নয়, বরং সেরেসের অভ্যন্তরের উষ্ণ, লবণাক্ত জলাধার থেকে ক্রায়োভলকানিজমের মাধ্যমে পৃষ্ঠে উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বামন গ্রহ সেরেসের অভ্যন্তরে একসময় একটি উষ্ণ, রেডিওঅ্যাকটিভ কোর ছিল, যা শত শত মিলিয়ন বছর ধরে অভ্যন্তরীণ তাপ উৎপন্ন করেছে। এই তাপের ফলে শিলাময় কেন্দ্রে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, যা হাইড্রোজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস উৎপন্ন করে।
আর এই গ্যাসগুলো খুব সম্ভবত তরল জলে মিশে প্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক শক্তি তৈরি করতে পারে, যেমনটি আমাদের পৃথিবীর গভীর সমুদ্রের হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে দেখা যায়। NASA’র Dawn মিশন ইতিমধ্যে সেরেসে তরল জলের অস্তিত্ব, লবণাক্ত খনিজ, এবং কার্বন-ভিত্তিক অর্গানিক অণুর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে।
নতুন গবেষণা এই তিনটি উপাদানের সঙ্গে যুক্ত করেছে একটি দীর্ঘস্থায়ী অভ্যন্তরীণ শক্তির উৎস, যা প্রাণের বিকাশের জন্য খুবই অপরিহার্য। যদিও বর্তমানে সেরেসের অভ্যন্তরীণ তাপ কমে গেছে এবং সেই সক্রিয় সময়কাল অনেক আগেই হয়ত শেষ হয়ে গেছে। তবুও বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি হয়ত অতীতের কোনো জটিল ও সম্ভাব্য এলিয়েন লাইফের চিহ্ন বহন করে আছে।
সেরেসের ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস −১০৩°C হলেও সূর্যের আলো যে স্থানে সরাসরি পরে, সেখানের তাপমাত্রা হয়ত প্রায় মাইনাস −৪০°C পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। তাছাড়া সূর্য থেকে এই বামন গ্রহটি গড়ে ২.৮ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (এইউ) বা ৪১৩ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর কোন নিজস্ব ম্যাগনেটিক ফিল্ড নেই।
পৃথিবীর হিসেবে সেরেসে একটি বছর পূর্ণ হতে সময় লাগে প্রায় ১,৬৮০ দিন এবং নিজ অক্ষে আবর্তন করতে সময় লাগে মাত্র প্রায় ৯ ঘণ্টা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই চরম শীতল পরিবেশের মধ্যেও, এর বরফের নিচে লুকিয়ে থাকা লবণাক্ত মহাসাগরের বুকে হয়ত এলিয়েন লাইফ লুকিয়ে থাকতে পারে।
আজ থেকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর ্পূর্বে সৌরজগতের বাকি অংশের সাথে সেরেস গঠিত হয়েছিল, যখন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ঘূর্ণায়মান গ্যাস এবং ধুলো টেনে নিয়ে একটি ছোট বামন গ্রহ হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরা সেরেসকে একটি “ভ্রূণ গ্রহ” হিসাবে বর্ণনা করেন, যার অর্থ এটি গঠন শুরু করেছিল কিন্তু পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি। এর এখনো একটি খুবই পাতলা জলীয় বাষ্প সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল বিদ্যমান রয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, বিজ্ঞানীদের অনুমিত এই সম্ভাবনা বামন গ্রহটিকে আমাদের সৌরজগতের অন্যতম সম্ভাব্য এলিয়েন লাইফ বা জটিল প্রাণের আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেরেসের এই উজ্জ্বল লবণাক্ত অঞ্চলগুলো শুধু একটি সুন্দর দৃশ্য নয়; বিজ্ঞানীদের মতে, এগুলো এখনো জটিল প্রাণ বা এলিয়েন লাইফের বিকাশের উপযোগী ইকোসিস্টেমের ইঙ্গিত বহন করতে পারে।##তথ্যসূত্র: NASA, Wikipedia

